নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ হাঁটতে কষ্ট, উঠে দাঁড়াতে কষ্ট। চিৎ হয়ে শেষ কবে ঘুমিয়েছে মনে নেই। ব্যথায় রাতে ঘুম হয় না। নিজের ওজনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ টিউমার নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে ১২ বছরের শিশু কাওছার। একটি নয়, দুটি নয়, ছয়টি বড় বড় টিউমার তার পেটে। ইতোমধ্যে সাহায্যের টাকায় চারটি টিউমার অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করতে পারলেও রয়ে গেছে আরও দুটি। দিন যত যাচ্ছে, টিউমার তত বড় হচ্ছে। খুব বেশিদিন অপেক্ষা করলে টিউমার ফেটে কাওছার মারা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। এজন্য বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটছে কাওছার। দুইদিন আগে এসেছে বরিশালে। এর আগে গেল বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত বরিশালে ছিল তারা। এক বছর পর চলতি বছরের ১ মার্চ আবারও বরিশালে এসেছে। সরকারি অফিস, আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জনসমাবেশ দেখলেই ছুটে যাচ্ছে সাগ্রহে। অনুনয়-বিনয় করে পাঁচ-দশ টাকা সাহায্য নিচ্ছে। সেই টাকা জমা দেয় ফলপট্টি ভোলা বোডিংয়ের ম্যানেজার সোহেলের কাছে। বরিশালে এলেই তারা এই বোডিংয়ের ১১ নম্বর কক্ষে থাকে। দুটি বিছানার ঘিঞ্জি পরিবেশে বিশ্রামের সুযোগ পায়। এ নিয়ে অবশ্য কোনো অভিযোগ নেই তাদের। দিনে খাওয়ার জন্য দেড়শ টাকা দিতে হয়। বাকি টাকা নিয়ে আবার ৪-৫ দিন পর ফিরে যাবে নিজ বাড়িতে। সেখান থেকে আবার অন্য কোনো জায়গায় যাবে সাহায্য তুলতে। এভাবেই টিউমারের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে কাওছার। মাঝে মাঝে মন চায় মরে যেতে। আবার বাঁচতেও মন চায়। জীবনে কখনো খেলাধুলার মাঠে ইচ্ছেমতো একটি দৌড় দিতে পারেনি। আবার বসতে পারেনি পড়ার টেবিলে। বিড়বিড় করে কাওছার বলে, মানষের সাহায্যের টাহায় (টাকায়) দুইডা কাটছি। আর দুইডা এ্যাকছেড় কষ্ট দেয়। মনে চায় মইর্যা যাই। কিন্তু বাঁচতেতো মোরও মন চায়। ভোলার দৌলতখান উপজেলার ৯ নম্বর ভবানীপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কাওছার। এই ১২ বছরের চলমান জীবনের শুরুটা স্বাভাবিকই ছিল। ২-৩ বছর বয়সে বাবা বশিরের কোলে চড়ে নদীতে মাছ ধরতে যেত। কিন্তু হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে যায়। কাওছার বলে, ৪-৫ বছর আগে আব্বায় গেছিল গাঙে। তুফান উঠছে। ডুইব্বা (ডুবে) মরছে। আর ফেরে নাই। হুনছি লাশ পাইছিল। মায় মোরে দেহায় নাই। হুনছি আব্বায় মইরা পইচ্চা (পঁচে) গ্যাছে। কাওছার আরও বলে, আব্বায় বাঁইচ্যা থাকলে মোর এত কষ্ট হরা (করা) লাগত না। এতদিনে টাহা (টাকা) জোগাড় করত। মোর কষ্টডা শ্যাষ হইত। এহন মায় একলা কেমনে কী করবে? কাওছারের বড় ভাই নাজেম জানান, এর আগে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়েছে। বাকি টাকা জোগাড় হলে আবারও ঢাকায় যাব অস্ত্রোপচার করাতে। এবার দ্রুত যেতে বলেছে ডাক্তার। নাহলে পেট ফাইট্টা মরবে কাওছার। নাজেম আরও বলেন, ছোটবেলা থেকেই মাঝে মাঝে পেট ব্যথা বলে কান্নাকাটি করত। ৫-৬ বছর আগে হঠাৎ পেট বড় হয়ে যায়। ডাক্তার জানায়, পেটের মধ্যে অনেকগুলো টিউমার আছে। এরপর দিনে দিনে আরও বড় হতে থাকে পেট। পেট থেকে পযার্য়ক্রমে চারটি টিউমার অপারেশন করা হলেও সঙ্কট বাড়ছে প্রতিদিন। যেহেতু টিউমার খুব বড় হয়ে গেছে, যেকোনো সময় ফেটে মারা যেতে পারে কাওছার। কিন্তু টাকা এখনো সংগ্রহ হয়নি। কাওছার বলে, ডাক্তারে কইছে শ্যাষ অপারেশন করতে ৪ লাখ টাহা লাগবে। এত টাহা মোরা কোথায় পামু? মুই কী বিপদে আছি? মানষের ধারে (কাছে) গ্যালে দুই টাহা, পাঁচ টাহা দেয়। কেউ বড় সাহায্য দেয় না। সুস্থ হয়ে মাকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে চায় কাওছার। তার অসুস্থতার জন্য মা লাইজু বেগম দিনের অধিকাংশ সময়ই কান্না করেন বলে জানায় কাওছার। ভবানীপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার রফিকুল ইসলাম বলেন, কাওছারের পরিবারটি অত্যন্ত গরিব। বশির (কাওছারের বাবা) মারা যাওয়ার পর দুর্দশা আরও বেড়েছে। এই অবস্থায় কাওছারের চিকিৎসা খরচ বহন করা তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব না। আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী একটি প্রতিবন্ধী কার্ড করে দিয়েছিলাম। কার্ডের ভাতা এখনো পাওয়া শুরু করেনি। ওদের নিজেদের মুঠোফোন নেই। তারপরও কাওছারকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার জন্য তিনি সবাইকে অনুরোধ করেছেন।
Leave a Reply